আমূল – ইতিহাসের সরণীতে বাণিজ্যের পথচলা

আমূল – ইতিহাসের সরণীতে বাণিজ্যের পথচলা

“যা নেই ভারতে তা নেই ভূভারতে”… মহাভারতের দেশ… রামায়নের দেশ… ভারতবর্ষ| সেই মহাভারতের কালে ব্রজভূমির সুস্বাদু মাখন পৌঁছেছিল গুজরাতের দ্বারাবতীতে, সুদূরদর্শী দ্বারকাপতির হাত ধরে। যে দেশ এক সময় শুধুমাত্র মুনিঋষিদের বলে সারা পৃথিবী জানতো, সেই মুনিঋষিদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ছিল ‘দুগ্ধ’ বা ‘দুধ ‘| সেজন্য তাঁরা গোধনের সেবা করতেন।

এই যুগে সেই গোধন এবং দুধ কে বিপণনের এক উচ্চ মার্গে নিয়ে যাওয়া ‘আমূল’ ভারতীয় ব্যবসা বাণিজ্যের চিত্রটা অত্যন্ত মসৃন করে বুঝিয়ে দেয় | কে বলেন ভারতীয়রা বাণিজ্য বোঝেন না?

ভার্গিস কুরিয়েন। ১৯২১ সালে অধুনা কোদাইকানালে যাঁর জন্ম | যিনি পরবর্তী সময়ে ‘দুগ্ধ মানব’ উপাধি পাবেন… কী অসম্ভব অধ্যবসায়, কী দুর্ধর্ষ বাণিজ্যবোধ! ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গোধনসেবীদের এক ছাদের নীচে এনে গুজরাতের আনন্দ-এ সম্মিলিত ব্যবসায়ের রূপ দিলেন তিনি। অতি প্রয়োজনীয় তরল থেকে ‘মাখন’, ‘পনির’, ‘কনডেন্সড মিল্ক’, ‘চীজ’, ‘দই’ প্রায় সব উপকরণ প্রস্তুত করে এক দীর্ঘ যাত্রাপথ সুগম করল আমূল – ‘দ্য টেস্ট অফ ইন্ডিয়া’! 

গ্রামের মানুষ যাঁরা বাড়িতে গরু-মহিষ রাখেন তাঁদের বাড়ির দুধকে এই ভাবে পরিমার্জনা করে একটা আস্ত কর্মযজ্ঞ তৈরী হয়েছিল সেই কোন যুগে, যা আজও প্রবহমান | গ্রাম্য রোজগার যোজনাতে ৩ নম্বর জায়গা পায় আমূল এবং আমূল ই ভারতবর্ষের প্রথম কোঅপারেটিভ, পোশাকি নাম – ‘গুজরাত কোঅপরেটিভ মিল্ক মার্কেটিং ফেডারেশন লিমিটেড’ |

সমস্ত অর্থনীতিবিদরা বারবার ভারতবর্ষের দ্রারিদ্রদূরীকরণের কথা বলেন | যে কাজটি আমূল ইন্ডিয়া চূড়ান্ত সফলভাবে আজও করে চলেছে | আমূল ইন্ডিয়া পাঁচ দশক ধরে এদেশকে বাণিজ্যিক ভাবে বিদেশী পুঁজি আনতে সাহায্য করেছে | তৈরী হয়েছে ‘আনন্দ প্যাটার্ন ‘| বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা আজ চালিত হয় এই ব্যবসায়িক বুদ্ধি দিয়ে | সত্যি! কত মানুষের রোজগার, কত মানুষের কর্মসংস্থান |

আমূল ইন্ডিয়ার বার্ষিক (২০১৯-২০) ব্যবসা ভারতীয় মুদ্রায় ৩৮৫৫০/- কোটি টাকা ছাড়িয়েছে (মার্কিন ডলার ৫.৪ বিলিয়ন) | বর্তমানে আমূল ইন্ডিয়ায় কর্মরত ১০০০০ কর্মীর নিরলস প্রচেষ্টায় প্রতিটি পরিবারে আমূল দুধ এবং পানীয় এক বিশ্বস্ততার জায়গা করে নিয়েছে | প্রতিদিন দুধের জোগানে আরো প্রায় ৩.৬ মিলিয়ন সভ্য অন্তর্ভুক্ত |

দুগ্ধজাত খাদ্য মানুষের পুষ্টির সঙ্গে সংযুক্ত অর্থাৎ স্বাস্থ্যকে কেন্দ্র করে বাণিজ্য। ১৯৮০ সালে ‘বিশ্ব খাদ্য সংস্থা’ সম্মান পায় আমূল | ব্যক্তিগতভাবে ‘ পদ্মশ্রী ‘, ‘পদ্মভূষণ’, ‘পদ্মবিভূষণ’ সবই পান সংস্থার প্রাণপুরুষ ভার্গিস কুরিয়েন |

১৯৪৬ সালে ত্রিভুবনদাস প্যাটেল পরাধীন ভারতবর্ষে দাঁড়িয়েও যে বাণিজ্য সংস্থার কল্পনা করেছিলেন পরিশ্রম, সাহস, অধ্যবসায়কে পুঁজি করে, পরবর্তীকালে তিনি ভার্গিস কুরিয়েনকে সেই দায়িত্ব দেন এবং তা সফলভাবে পালন করাতেই এতো দীর্ঘ সময় ধরে আমূল সর্বভারতীয় ব্যবসায়িক স্তরে এখনও অন্যতম সফল এক সংস্থা| এই ব্যবসায়িক দূরদর্শিতার ফলেই খাদ্য এবং তরল পানীয় হিসেবে দুধ কে মাধ্যম করে আজও সারা পৃথিবীর কাছে আমূল একটি উদাহরণ|

আজও বাড়িতে বাড়িতে মাখনের বদলে আমূল নামটাই যেন আগে আসে | এককথায় গুঁড়ো দুধের ডাক নাম আজও ‘আমূল’ | সদ্যোজাতের জন্য দুধ কিনতে গেলেও ‘আমূল স্প্রে’ এখনও প্রথম পছন্দ | নামিদামি শপিং মলে বা বিদেশি আওতাভুক্ত কোনো খাদ্যবিপণীতে ঢুকলে চট করে পনির বা চীজের কাউন্টারে আমূল নামটাই প্রথমে চোখে পড়ে| আর আমূল ইন্ডিয়ার বিজ্ঞাপনে চোখে ভাসে দুদিকে ঝুটি বাঁধা একটি মিষ্টি বাচ্চা মেয়ে, যার বয়সও ভারতবর্ষের নষ্টালজিয়াতে কোনো দিনই বাড়বে না| ‘আটার্লি ব্যাটার্লি ডিলিসিয়াস’ ||

আত্মনির্ভরতা ভারতবর্ষের চিরপুরাতন নীতি | বাণিজ্যিক সাফল্য খুঁজতে হলে সাত সমুদ্দুর পেরোতে হবে? না, একথা নেহাতই মানা যায় না | 
আরও জানতে ফোন করুন এই নম্বরে +91 9051052222 বা ইমেল করুন [email protected]

অনিন্দিতা চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *