মুদ্রাস্ফীতি আজ সারা বিশ্ব জুড়ে মানুষের উদ্বেগের বিষয়। কারণ মুদ্রাস্ফীতি সম্পদের ক্রয়ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। সম্পদ রক্ষার প্রয়োজনের কথা ভেবে মানুষ প্রতিনিয়ত মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এক সময় ছিল বিনিময় প্রথা। মানুষ নিজেদের উৎপাদন করা খাদ্যশস্য ও অন্যান্য সামগ্রীর বিনিময়ে তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য ও বস্তুসামগ্রী জোগাড় করত। সভ্যতার এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রথা বন্ধ হয়ে বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে চালু হয় মুদ্রা । আজ তা কড়ি-সোনা-রূপা-তামার পথ পার হয়ে সর্বজনগ্রাহ্য ছাপানো মুদ্রা।
সম্পদের মধ্যে সবথেকে লিক্যুইড অর্থাৎ বিনিময়যোগ্য সম্পদ হল অর্থ। অর্থের মূল্য তার ক্রয়ক্ষমতা। আর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে যখন আগের তুলনায় কম পরিমাণ পণ্য বা পরিষেবা পাওয়া যায় তখন তার জন্য দায়ী হয় মুদ্রাস্ফীতি।
একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে দৈনন্দিন ব্যবহারের যোগ্য খাদ্য, বস্ত্র ইত্যদির মতো পণ্য ও পরিষেবার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া বা তাদের অর্থমূল্যের হ্রাস পাওয়ার নাম হল – মুদ্রাস্ফীতি। যদিও ক্ষণস্থায়ী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকে মুদ্রাস্ফীতি বলা হয় না।
মুদ্রাস্ফীতি মূল্যসূচক দ্বারা নির্ণয় করা হয়। মূল্যসূচক মুলত দুধরণের – উপভোক্তা মূল্যসূচক ও পাইকারি মূল্যসূচক।
মুদ্রাস্ফীতি প্রধানত তিন রকমের। ডিম্যান্ড পুল অর্থাৎ চাহিদা নির্ভর, কস্ট পুশ অর্থাৎ দাম নিয়ন্ত্রিত এবং বিল্ট ইন অর্থাৎ নির্ধারিত।
সম্প্রতি (১৪ জুন ২০২২) আয়কর বিভাগ ২০০১-২০০২কে আর্থিক ভিত্তি বছর ধরে খরচ মুদ্রাস্ফীতির (সিআইআই) যে তথ্য প্রকাশ করেছে, ২০২২-২০২৩ আর্থিক বছরে তার সূচকমূল্য ৩৩১। এই তথ্য মূলত সম্পদের দীর্ঘমেয়াদী মূলধনী লাভ করের হিসাবের জন্য। ইক্যুইটি বিনিয়োগে দীর্ঘমেয়াদী মুলধনী লাভ করের অঙ্ক আলাদা, সেখানে এই সূচকের ভূমিকা নেই। তবে ঋণপত্রের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীর কাছে এই সূচক লাভজনক হলে তার সুবিধা নেওয়ার সুযোগ আছে। ২০০১-২০০২ আর্থিক বছরের সূচক ১০০, অর্থাৎ চলতি আর্থিক বছরে সেই ১০০ টাকা দাঁড়িয়েছে ৩৩১ টাকায়।
ক্রমিক সংখ্যা | আর্থিক বছর (FY) | খরচ মুদ্রাস্ফীতি সূচক (CII) |
1 | 2001-02 | 100 |
2 | 2002-03 | 105 |
3 | 2003-04 | 109 |
4 | 2004-05 | 113 |
5 | 2005-06 | 117 |
6 | 2006-07 | 122 |
7 | 2007-08 | 129 |
8 | 2008-09 | 137 |
9 | 2009-10 | 148 |
10 | 2010-11 | 167 |
11 | 2011-12 | 184 |
12 | 2012-13 | 200 |
13 | 2013-14 | 220 |
14 | 2014-15 | 240 |
15 | 2015-16 | 254 |
16 | 2016-17 | 264 |
17 | 2017-18 | 272 |
18 | 2018-19 | 280 |
19 | 2019-20 | 289 |
20 | 2020-21 | 301 |
21 | 2021-22 | 317 |
22 | 2022-23 | 331 |
মুদ্রাস্ফীতির আরও একটা তথ্য – ১৯৮০ সালে ১০০ টাকায় যে পরিমাণ জিনিস কেনা যেত আজ সেই একই পরিমাণ জিনিস কিনতে ২২৪৬ .৮০ টাকা লাগবে।
আগেই উল্লেখ করেছি যে সবথেকে লিক্যুইড সম্পদ হল অর্থ। মানুষ সম্পদের একাংশ সম্পূর্ণ লিক্যুইড অবস্থায় রাখতে চায় ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার আশঙ্কা করে। নগদ অর্থ হাতে রাখে বা ব্যাঙ্ক আমানতে রাখে ভবিষ্যতের বিপদআপদ বা অনিশ্চয়তার মোকাবিলা করার জন্য। কিন্তু ব্যাঙ্ক আমানত থেকে প্রাপ্ত সুদ দীর্ঘমেয়াদে মুদ্রাস্ফীতিকে হারাবার উপযুক্ত মাধ্যম নয়। ব্যাঙ্ক-সঞ্চয়ের সুদের হার যদি ৪% হয়, বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির হার ৬%-এর কাছে। দীর্ঘমেয়াদে পিপিএফ আমানতে সুদ ৭.১%, সেখানে এদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে মুদ্রাস্ফীতির হার ১০%-এর কাছাকাছি।
সঞ্চয় নয়, সঠিক বিনিয়োগই দীর্ঘমেয়াদে মুদ্রাস্ফীতিকে হারিয়ে সম্পদ রক্ষা করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক বিনিয়োগ না করার মানে – মুদ্রাস্ফীতিকে দরজা খুলে দেওয়া কষ্টার্জিত অর্থ কেড়ে নেওয়ার জন্য।
মুদ্রাস্ফীতি থেকে সম্পদ রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন সঠিক বিনিয়োগ পরিকল্পনা। তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ –
- নিজস্ব সম্পদের বর্তমান মূল্যায়ন
- দীর্ঘমেয়াদে লাভের প্রত্যাশিত হার
- ঝুঁকি নেবার ক্ষমতার মূল্যায়ন
- সঠিক বিনিয়োগের মাধ্যম নির্বাচন
- সম্পদ এর সঠিক বণ্টন এবং বহুমুখী বিনিয়োগ
এবার যে যে মাধ্যম গুলিতে বিনিয়োগ করা যেতে পারে সেগুলো দেখে নিই –
- ইক্যুইটি শেয়ার – দীর্ঘমেয়াদে ও সঠিক নির্বাচনে মুদ্রাস্ফীতিকে হারাতে অন্যতম প্রধান বিনিয়োগ মাধ্যম। দীর্ঘ মেয়াদে পুঁজি বৃদ্ধি এবং সম্পদ রক্ষার ব্যাপারে উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে পারে। এছাড়া ডিভিডেন্ড বা লভ্যাংশ থেকেও উপার্জন হয়। দীর্ঘমেয়াদী মূলধনী লাভ কর ১০% যা কেবল এক লাখ টাকার উপর লাভের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
- সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান (এসআইপি) – মিউচ্যুয়াল ফান্ড হাউস দ্বারা পরিচালিত, এসআইপি বা ‘সিপ’ নামে বিশেষ পরিচিত। এক উপযুক্ত বিনিয়োগের উপায়, যেখান থেকে দীর্ঘ মেয়াদে ফেরৎযোগ্য মুনাফা সম্পদ রক্ষার সহায়ক হতে পারে। বিবিধ ক্ষেত্রে বহুমুখী বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত এবং জনপ্রিয়। দীর্ঘমেয়াদী মূলধনী লাভ কর ইক্যুইটি ফান্ডের ক্ষেত্রে ১০% এবং এক লাখ টাকার উপর লাভের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ডেট ফান্ডের ক্ষেত্রে কর বেশি হলেও ইন্ডেক্সেশনের সুবিধা আছে।
- এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড (ইটিএফ) – স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ও লেনদেন হয়। মিউচ্যুয়াল ফান্ড এর সঙ্গেও বিশেষ মিল আছে । বহুমুখীকরণের মাধ্যমে ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে বলে বিনিয়োগক্ষেত্র হিসাবে উপযুক্ত।
- সভারেন গোল্ড বন্ড (এসজিবি) – ডিম্যাট অবস্থায় রাখা যায়। সোনা বা গয়না রাখার ঝুঁকিমুক্ত এবং সুরক্ষার জন্য বিমা বা লকার খরচ লাগে না, বিশুদ্ধতা-সংক্রান্ত ঝুঁকিও নেই। সোনার দাম বাড়ার সঙ্গে মূলধনী লাভ হয়, আবার সুদ পাওয়া যায় ২.৫% হারে। সুদ ও আসল সরকার নিশ্চিত করে। দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগে করছাড় আছে, আবার স্বল্পমেয়াদে বাজারে বিক্রির সুবিধাও আছে।
- গোল্ড ইটিএফ – স্টক ইটিএফের মত এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ও লেনদেন হয়। যেহেতু ডিম্যাট অবস্থায় রাখা যায় , সুরক্ষার জন্য বিমা বা লকারের প্রয়োজন নেই। বিশুদ্ধতা সংক্রান্ত ঝুঁকিমুক্ত। সোনাতে প্রযোজ্য মূলধনী করের আওতায় পরে কিন্তু সম্পত্তি করের আওতায় নয়।
- রেইট বা রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট – একটি বিনিয়োগমাধ্যম যারা বাণিজ্যিক উচ্চমূল্যের রিয়েল এস্টেট-এ বিনিয়োগ করে অথবা সেই সম্পত্তি মর্টগেজ বা বন্ধক রেখে ঋণ দেওয়ার ব্যবসা করে। দীর্ঘ মেয়াদে পুঁজি বৃদ্ধি এবং ডিভিডেন্ড থেকে ভাল উপার্জনের সুযোগ আছে। বহুমুখীকরণের মাধ্যমে ঝুঁকি কমানোর উপযোগী বিনিয়োগক্ষেত্র ।
ঝুঁকি নেবার ক্ষমতা বিচার করে, সঠিক ও বহুমুখী বণ্টনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ পরিকল্পনা করে আগামী দিনে মুদ্রাস্ফীতির হাত থেকে সম্পদ রক্ষা করা সম্ভব। না হলে বিনিয়োগে সফল হওয়া সম্ভব নয়।
আরও জানতে ফোন করুন এই নম্বরে +91 9051052222 বা ইমেল করুন [email protected] এ।
– প্রবাল রায়