ফ্যাশন না স্টাইল? কোনদিকে চলা অভ্যাস? নিজের মতে কেনাকাটা? নাকি যা চলছে বাজারে?
এক পুজোর মরশুমে এক নামজাদা শাড়ির দোকানে এই কথোপকথন কানে এল – এক মা তাঁর তরুণী কন্যার শ্বাশুরির জন্য একটি দুর্দান্ত এবং দামী লালপেড়ে সাদা কাঞ্জিভরম কিনতে চাইছেন। বোঝা গেল নতুন বিয়ের ব্যাপার। মেয়েটি মাকে প্রাণপণে বোঝাবার চেষ্টা করছে, শাড়িটি তার শ্বাশুরিমার কোন প্রয়োজনে কাজে আসবে! মা নাছোড়! তিনি এই প্র্যাকটিকাল মতামত শুনতে রাজি নন। মেয়েটির বাবা বেচারা এই দুই মতের মধ্যিখানে পড়ে একেবারে স্যান্ডউইচ!
এবার কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে বসেন, ওই দামী শাড়ির দোকানে কোন প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে জুটেছিলাম, তাহলেই মুশকিল! কারণ পুজোর সময় নতুন শাড়ি কেনাই দস্তুর। না কিনলে প্রেস্টিজ থাকে না, কিংবা সংস্কারে বাধে! শাড়ির আলমারি উপচে মিউজিয়াম হওয়ার জোগাড় হলেও এই ক্ষেত্রে বাঙালির প্রয়োজন এবং চাহিদার মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখা মুশকিল!
বাঙালির পুজোর হুজুগে ঠিক কত কোটি খরচ হয় তার হিসেব কে রাখে! ওই বিপুল অর্থে কারও কোনও উপকার করা যেত কিনা, অর্থভাণ্ডারের বিপুল অপচয় রুখলে অর্থনীতির কোন কোন উদ্দেশ্য সাধন করা যেত, সে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গ। আসল কথা হচ্ছে, হুজুগ! আপনি-আমি কেউই এর আওতার বাইরে নই।
আসলে কী কী করা উচিৎ, আপনি-আমি সকলেই জানি। মানি কে কতটা তা আলাদা কথা। শুধু বলার চেষ্টা করছি, মানলে কী লাভ হতে পারে!
শুধু অপচয় না করলেই যে অভাব হবে না, তা কিন্তু নয়! কারণ – অভাবের সংজ্ঞাটাই আমাদের জমানায় সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আমাদের হাতে অনেক অস্ত্রশস্ত্র – প্রিঅ্যাপরুভড পার্সোনাল লোন, ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদি। এদিকে খোলা বাজারের বিপুল হাতছানি। অনেক সময়ে না বুঝেই জমার তুলনায় খরচ বেশি হয়ে যায়। বেশি সুদে ধার করা অনেকের অটোমেটিক চয়েস হয়ে দাঁড়ায়, তার সঙ্গে পুরনো দিনের অভাবের কোনও মিল আছে বলে মনে হয় না।
মাসে মাসে টাকা জমানো খুব ভাল অভ্যাস – এজন্য চাকরি পাওয়ার প্রথম দিন থেকে বিভিন্ন স্কিমে সবাই টাকা জমাতে আরম্ভ করেন, কিছু না হলে নিদেনপক্ষে এক-আধটা এসআইপি। কিন্তু মাঝপথে রুখে যান কেউ কেউ। কখনও কখনও বাড়াবাড়ি রকমের প্রয়োজনে। বাচ্চার স্কুলে ভর্তির টাকা দিতে হবে, এসআইপি এখন হবে না! হঠাৎ বন্ধুরা মিলে বিদেশ যাওয়ার প্ল্যান – এসআইপি বন্ধ এবং ফান্ড থেকে কিছু তুলে নেওয়া। এরকম আরও কত কী! আরও অনেক গুরুতর প্রসঙ্গ না হয় বাদই দেওয়া গেল।
তাহলে করবেন কী? এসআইপি এবং অন্য সব জমানোর সঙ্গে একটা করে জীবনের উদ্দেশ্য জুড়ে ফেলুন। এই এসআইপি বাচ্চার উচ্চশিক্ষার জন্য, পিপিএফ নিজের অবসর জীবনের খরচ চালানোর জন্য, ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট-এর অমুক শেয়ার মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য – এরকম ভাবে। দেখবেন, হুজুগে জমানো এবং হুজুগে খরচ – দুটোই কমবে। ওই টাকায় হাত দেওয়ার আগে দুবার কেন, দশবার ভাববেন।
পুজো বোনাসের কিছুটা সরিয়ে প্রত্যেক বছর একটা ফান্ডে ফেলুন, ওই ফান্ড থেকে বেড়াতে যাওয়ার খরচ উঠে আসবে। অর্থবছর শেষে যদি পারফরম্যান্স বোনাস পান, তা থেকে পিপিএফ আকাউন্টের টাকা ফেলুন, যত আগে, তত বেশি সুদ পাবেন। যদি উপায় থাকে, মূল মাইনের ১০% এনপিএস-এর এমপ্লয়্যার কোটায় জমা করার দরখাস্ত দিন, টাকাও জমবে, আয়করও বাঁচবে। যাঁরা অনেক বেশি টাকা আয়কর গোনেন, তাঁদের জন্য এই পদ্ধতি বিশেষ সাশ্রয়কর।
এরকম অনেক আছে। হয়ত সকলেরই জানা। তবু করে ওঠা হয় না। এই পুজোয় মা দুগগার নাম করে করে ফেলুন। ফিনান্সিয়াল প্ল্যানিং কোনও বড়সড় গাল ভরা ব্যাপার নয়। নিতান্তই কিছু ব্যক্তিগত হিসেবনিকেশ, যা না করলেই নয়। সূচনা অন্তত নিজে করুন। স্বামীস্ত্রী দুজনে নিরালায় বসুন, নিত্যদিনের ঝক্কি-ঝামেলা ঘণ্টাকয়েকের জন্য দূরে রাখুন, তক্কবিতক্ক বন্ধ রাখুন, প্ল্যানিং করুন। দেখবেন, এই প্ল্যানিং আপনাদের জীবনে ভবিষ্যতে অনেক কাজে লাগবে।
মাসের খরচ, বছরের খরচ, এককালীন খরচ লিখুন। তারপর হিসেব করুন বাকী সব কিছু। একদিনে সব হবে না, প্রত্যেক সপ্তাহে একদিন করে হিসেবের জন্য রাখুন। কোনওদিন খরচ, কোনওদিন ইনসিওরেন্স, কোনোদিন ডিম্যাট অ্যাকাউন্টের জমানো সম্পত্তির হিসেব করুন। সময় করে নিজের প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি ইত্যাদির হিসেবও করতে হবে। এইসব হিসেবনিকেশ আপনার ফিনান্সিয়াল প্ল্যানিং-এর মূল ভিত।
টার্ম লাইফ ইনসিওরেন্স বা স্বাস্থ্যবিমা যে অতি প্রয়োজনীয়, তা যেমন সকলের জানা, তেমনই উইল। উইল করতে ভুলবেন না। পরিবারে যত কম সদস্যই থাকুন, উইল এড়ানো উচিৎ নয়।
একবার ভাল অভ্যাস শুরু করতে পারলে হুজুগ এমনিই দূর হঠে। করেই দেখুন না! অসুবিধে হলে আমরা আছি। যা বুঝবেন না বা করতে অসুবিধেয় পড়বেন, নির্দ্বিধায় আমাদের প্রশ্ন করতে পারেন।
আরও জানতে ফোন করুন এই নম্বরে +91 9051052222 বা ইমেল করুন [email protected]
– অদিতি নন্দী