বিশ্বযুদ্ধ যাঁরা দেখেছেন তাঁরা কী বলবেন জানি না। যারা শুধু করোনা যুদ্ধটাই দেখলাম, তারা ভাবছি এ কী হল!
মুম্বই শেয়ারবাজারের সূচক – সেনসেক্স যে মাসখানেকের ব্যবধানে ৪১০০০ থেকে সোজা ২৫০০০-এর ঘরে নেমে আসবে তা কী ভেবেছিলেন কেউ? তারপর আবার কী ঘটল যে করোনার আবহেই ৩৮০০০-এ ফিরতে হল সেনসেক্সকে! এই ডামাডোলে কী করবেন শেয়ারবাজারে – যাঁরা বিনিয়োগ করতে চান, অথবা যাঁরা আগে বিনিয়োগ করে ফেলেছেন, কিংবা যাঁরা করতে চাইছেন, কিন্তু এখনও করে উঠতে পারেন নি? কী কৌশল হবে – শেয়ারবাজারে করোনা যুদ্ধে?
কৌশল ১ – কোন সময়ে কী করবেন
যেকোনো জরুরি অবস্থার মত করোনা অতিমারীর সময়েও সারা বিশ্বে বিনিয়োগ অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি। সোনার দাম আকাশচুম্বী, কারণ এমন পরিস্থিতিতে সোনাকেই সাধারণত নিরাপদ মনে করা হয় বিশ্ব জুড়ে। এই পরিস্থিতিতে কখন কী করবেন?
শেয়ারবাজারে সঠিক সময়কে বেছে নিতে ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখার জুড়ি নেই। তাই একটু বেশি সময় পিছিয়ে যেতে হবে। সেই সেপ্টেম্বর ২০০৮ – লেহম্যান ব্রাদার্স-এর পতনে কেঁপে ওঠা ওয়াল স্ট্রিট! তারপর বিশ্ব জোড়া অর্থনৈতিক সুনামি! ২১০০০ থেকে ভারতে শেয়ারসূচকের ৮০০০-এ ফিরে আসা – ছমাসের ব্যবধানে।
দফায় দফায় ঘুরে দাঁড়িয়েছিল শেয়ারবাজার। প্রথম দফায় সেনসেক্স ১৪০০০, তারপর ২২০০০, তারপর ২৯০০০, তারও পর ৩৪০০০, ৩৬০০০ পার হয়ে ৩৯০০০… বেশ কিছুকাল পরে ৪০০০০ এর বেড়া টপকে অবশেষে ৪২০০০, সময় – জানুয়ারি, ২০২০। ১১ বছরের এই লম্বা যাত্রাপথে মাঝেমধ্যে সাময়িক বিশ্রাম। এছাড়া বড় কোনও নীচে নামা বলতে বড় জোর হাজার পাঁচেক পয়েন্ট – তবে লম্বা সময় নিয়ে! ২০১৮-র দ্বিতীয়ার্ধে একবারই ৩৫০০ পয়েন্টের মত নামতে দেখা গিয়েছিল সেনসেক্সকে, তবে ঘুরে দাঁড়াতে ৬ মাসের বেশি সময় লাগেনি।
এত ইতিহাস টেনে আনার উদ্দেশ্য একটাই – করোনাপর্বে টেকনিক্যাল লেখচিত্রের একটি যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা খুঁজে বার করা। যাঁরা লেখচিত্র বিশ্লেষণ করে থাকেন, তাঁরা সবাই বেশ বুঝছিলেন, যা হচ্ছে তা অস্বাভাবিক। উত্থানের পর অন্তত একতৃতীয়াংশ পতন যদি না হয়, তাকে যথাযথ সংশোধন প্রক্রিয়া (তত্ত্বগত ভাষায় ‘কারেকশন’) বলা যায় না। ভিতটা নড়বড়ে হয়ে থাকে। ৮০০০ থেকে ৪১০০০ – উত্থান যদি ৩৩০০০ পয়েন্টের মত হয়, এর একতৃতীয়াংশ অর্থাৎ ১১০০০। করোনা ছাড়া বিশ্বযুদ্ধই সম্ভবত একমাত্র কারণ হতে পারত, যা ৪১০০০-এর সেনসেক্সকে অন্তত ৩০০০০-এ নিয়ে গিয়ে ফেলার ক্ষমতা ধরে!
এই অসম্ভবকে সম্ভব করে, ৪১০০০ এর সূচক ২৫০০০-এর কোঠায় একমাসের ব্যবধানে নিয়ে গিয়ে, তারপর তাকে ৩০০০০-এই থিতু করে করোনা আর যাই হোক ভারতের শেয়ারবাজারের ভিতটাকে মজবুত করে দিয়েছে। যত ভয়ংকরই শোনাক, দেশের মার্কেট ক্যাপিটাল ৩৬% উড়ে যাওয়ার পরও এই তথ্য অস্বীকার করার উপায় নেই।
লেখচিত্র যদি সত্যি কথা বলে, তবে এই মুহূর্তে শেয়ারসূচকের ছবিতে ‘ডব্লিউ’ প্যাটার্ন সম্পূর্ণ হওয়া বাকি। অর্থাৎ আরও একটি অন্তত মাঝারি মাত্রার সংশোধন। কবে আর কখন, সেটা অপেক্ষার বিষয়।
তাহলে কী দাঁড়াল ?
১) যাঁরা ২৫০০০ যখন সেনসেক্স, তখন অর্থাৎ তলানিতে ঠিকঠাক বিনিয়োগ করতে পেরেছেন, তাঁরা যদি দেখেন, লাভ হাতের মুঠোয়, তবে তা ঘরে তুলে নেওয়ার কথা ভাবতে পারেন।
২) যাঁরা আগে থেকেই দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করে রেখেছেন, তাঁরা সংস্থা বিশেষে বিক্রি করার কথা ভাবতে পারেন।
৩) নতুন করে কিনতে হলে সংশোধনের সময়টা আদর্শ। তবে বাছাই বিশেষ জরুরি।
কৌশল ২ – কী কিনবেন, কেন কিনবেন
শেয়ার বাছাই শেয়ার বিনিয়োগের চিরকালীন প্রথম পাঠ। শেয়ারে বিনিয়োগে ঝুঁকি আছে। তাই বিনিয়োগ করার সময়ে ঝুঁকি এবং লাভের সম্পর্কটা মনে রাখতে হবে। আর ঝুঁকি নেওয়ার আগে ষোলআনা বুঝে, অঙ্ক কষে তবেই হাত বাড়াতে হবে শেয়ারবাজারে। সেজন্য চোখ রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট সংস্থার আয়ব্যয়ের খতিয়ানে।
১) আর্নিংস পার শেয়ার (ইপিএস) বা শেয়ার প্রতি আয় – সবচেয়ে শুরুতে যে শেয়ার কিনছেন তা লাভে আছে কিনা দেখতে হবে। সেজন্য দেখতে হবে এই অনুপাতটি। শেয়ার প্রতি আয় শূন্যের তলায় অথবা ঋণাত্মক মানে সংস্থাটি ক্ষতির মধ্যে। এই অনুপাত যত বেশি হবে, তত লাভ বেশি। তিন অঙ্কের ইপিএস খুঁজে বিনিয়োগ করতে পারলে ঝুঁকি অনেকটা এড়ানো যায়।
২) প্রাইস আর্নিংস (পিই) এবং প্রাইস টু বুক ভ্যালু (পিবি) রেশিও – এই দুটি অনুপাত বুঝিয়ে দেয় সংস্থাটির বাজার দাম বেশি না যথাযথ। বাজারদামকে যথাক্রমে শেয়ার প্রতি আয় ও খাতায় কলমে দামের (বুক ভ্যালু) সঙ্গে তুলনা করে এই অনুপাত দুটি বার করা হয়। অধিকাংশ সংস্থার ক্ষেত্রে পিই যদি ৫০ ছাড়ায়, তবে তা দামী বলে ধরতে হবে। পিবির ক্ষেত্রে ১ মানে আদর্শ। সংস্থা যদি কোনও কারণে পাততাড়ি গোটায়, তবে পিবি ১ হওয়ার অর্থ – বিনিয়োগের পুরোটাই ফেরত পাওয়া যাবে। পিবি ৩এর বেশি হলে সাবধান হওয়া প্রয়োজন। বহুজাতিক এফএমসিজি ও ওষুধ শিল্পক্ষেত্র অবশ্য এই ধারণার ব্যতিক্রম।
৩) ডেট ইক্যুইটি ও ইন্টারেস্ট কভারেজ রেশিও – এই দুটি অনুপাত বলে সংস্থাটির ঋণ তার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে কি না! ডেট ইক্যুইটি রেশিও ১ মানে তার ঋণ মোট ঋণ মূলধনের সমান। ইন্টারেস্ট কভারেজ রেশিও বলে সংস্থা্টি তার প্রদেয় সুদের কত গুণ লাভ করে। বিশেষ করে যেসব সংস্থা আর্থিক বাজারে কাজ করে, যাদের টাকা ধার দেওয়া ও নেওয়ার কাজ মুখ্য, তাদের ক্ষেত্রে এই দুটি অনুপাত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
৪) বিটা, আলফা ও ব্যালান্সড পোর্টফলিও – ‘বিটা’ একটি সংস্থার নিয়ম মেনে চলা ঝুঁকি মাপে। বিটা ১ মানে তার ঝুঁকি বাজারের মোট ঝুঁকির সমান। বিটা ১ এর কম হলে সংস্থাটি রক্ষণাত্মক, ১ এর বেশি হলে উল্টো। ১.৪-এর বেশি হলে আমরা ধরে নেব সংস্থাটির শেয়ারে একটু বেশি ঝুঁকি আছে । ০.৬ এর কম হলে ধরতে হবে তার দাম খুব কম সময়ে বাড়বেও না, কমবেও না। সাধারণত বেশ কিছু সংখ্যক কম-বেশি বিটার শেয়ার মিলিয়ে কিনে তাদের পোর্টফলিওটির ‘ওয়েটেড অ্যাভারেজ’ বিটা ১ করে নেওয়া যায়। একে ইক্যুইটির ‘ব্যালান্সড পোর্টফলিও’ বলা হয়।
অন্যদিকে ‘আলফা’ জানায় সংস্থাটির অঘটনের ঝুঁকি। আলফা ইতিহাস বা অঙ্ক মেনে চলে না। তাকে কাটাতে ডাইভারসিফিকেশন – অর্থাৎ বিবিধ সংস্থায় ভাগ করে বিনিয়োগই একমাত্র রাস্তা। চলতি বছরে করোনার জন্য বহু সংস্থায় আলফার দেখা মিলবে।
কৌশল ৩ – কী এড়াবেন, কী রাখবেন
যা সাধারণত ঘটে না, যা কোনও নিয়ম মেনে চলে না, তা আমরা ঐতিহাসিক তথ্য বা যুক্তি দিয়ে বিচার করতে পারি না। করোনা বিশ্ব এবং দেশের অর্থনীতির, সঙ্গে শেয়ারবাজারের একটা নিজের মত ছবি আঁকছে। দেশের চলতি শিল্পকে অনেক ক্ষেত্রেই সে জোর করে থামিয়ে দিয়েছে বা তাদের গতি কমিয়ে দিয়েছে, আবার কোনও কোনও শিল্পে জোয়ারও এনে দিয়েছে। যেমন – স্যানিটাইজার। অ্যান্টিভাইরাল। ল্যাপটপ কম্পিউটার। নেটওয়ার্ক সার্ভিস। হোম ডেলিভারি। করোনা আবহে যদি দামী গাড়ি বিক্রি কমে গিয়ে থাকে, বেড়ে গেছে দু চাকার চাহিদা। করোনা কারও কারও জন্য অভিশাপ হয়ে এসেছে, আবার কারও জন্য আশীর্বাদ।
যেসব শিল্পক্ষেত্রের জন্য করোনা শাপে বর হল, এখানে আমরা তাদের নাম দিলাম ‘কোভিড পজিটিভ’:
ফার্মাসিউটিক্যালস ও হেলথকেয়ার:
গত কয়েকমাস ধরে শেয়ারবাজারে যে কটি সুসংবাদ আমরা পেয়েছি, ওষুধ কোম্পানিরা নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে সবচেয়ে ওপরে। যে ভাল কাজগুলি এই ধরনের সংস্থা করতে পেরেছে, তা হল –
১) করোনার অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ রেমডিসিভির ও ফ্যাভিপিরাভির তৈরি করে বাজারে আনা।
২) ভ্যাকসিন তৈরির কাজে এগিয়ে থাকা।
৩) বাজারে প্যারাসিটামল ইত্যাদি সাধারণ ওষুধ -এর বর্ধিত চাহিদার যোগান দেওয়া।
৪) শুধু তৈরি ওষুধ নয়, সাগরপারের দেশগুলি যখন চীনের ওপর বাণিজ্যিক ভরসা হারিয়ে ফেলছে, তখন তাদের ওষুধের এপিআই সরবরাহ করার কাজেও এগিয়ে গেছে এদেশি বাল্ক ড্রাগ উৎপাদকরা।
৫) এদেশে এই লেখার সময় পর্যন্ত ২.৩৪ কোটি কোভিড টেস্ট হয়েছে। এর এক বৃহৎ অংশ করেছে বেসরকারি ল্যাব। এছাড়া অ্যান্টিজেন টেস্টিং কিট -এরও ব্যাপক ব্যবহার হয়েছে।
৬) দেশের ২১ লক্ষ করোনা রোগীর এক বৃহত্তর অংশের চিকিৎসা করেছে বেসরকারি হাসপাতাল।
৭) অনেক বেশি সংখ্যায় ভেন্টিলেটর থেকে পালস অক্সিমিটার – বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতির সরবরাহ করেছে সংশ্লিষ্ট সংস্থারা।
এফএমসিজি ও পারসোনাল কেয়ার :
১) হঠাৎ দেশে স্যানিটাইজার-এর চাহিদা হু হু করে বেড়েছে।
২) বেড়েছে স্বাস্থ্য সচেতনতা। বেড়েছে সাবান ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষাকারী ব্যক্তিগত পণ্যের চাহিদা।
৩) পরিবেশ সুরক্ষার জন্য বেড়েছে জীবানুনাশক সামগ্রীর ব্যবহার।
ফুড ও ফুড প্রসেসিং :
১) ঘরে তৈরি খাবারের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হয়েছে শহুরে প্রজন্ম। চাহিদা বেড়েছে ব্রান্ডেড গ্রসারি জাতীয় পণ্যের।
২) লকডাউন ও স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য ব্যবহার বেড়েছে বিস্কুট জাতীয় শুকনো খাবারের।
৩) ক্রেতারা প্রক্রিয়াজাত খাদ্য কিনতে নিরাপদ বোধ করেছেন।
ইনফরমেশন টেকনোলজি ও টেলিকমিউনিকেশন :
১) অর্ধেকের বেশি মানুষ বাড়ি থেকে কাজ করছেন। পড়াশোনা চলছে বাড়ি থেকে। চাহিদা বেড়েছে কম্পিউটার ও ল্যাপটপ-এর।
২) ব্যাপক ব্যবহার বেড়েছে স্মার্টফোন -এর।
৩) নেটওয়ার্ক সার্ভিস মানুষের জীবন ও জীবিকার অন্যতম মূল প্রয়োজনীয় পরিষেবা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সৌজন্যে – করোনা।
অটোমোবাইল – টু হুইলার ও হেভি ডিউটি ভেহিকল :
১) সামাজিক দূরত্ব পালন করতে এবং লকডাউনের কারণে ব্যক্তিগত দুচাকা যানের দিকে ঝুঁকেছেন মানুষ।
২) খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যব্যবহার্য সামগ্রীর জোগানের জন্য প্রয়োজন হয়েছে লরি-ট্রাক জাতীয় যানবাহনের। বিশেষত, এই সব ভারী যানবাহন যে পথ দিয়ে চলে, সেখানে করোনার প্রকোপ তুলনামূলকভাবে কম।
ই-কমার্স ও সাপ্লাই চেন :
১) লক ডাউন এবং সামাজিক দূরত্ব রক্ষার খাতিরে মানুষ যেখানে সম্ভব, বাড়ি থেকে অনলাইনে কেনাকাটা করতে চাইছেন। ইন্টারনেট-এর ব্যবহার বেড়ে যাওয়াও এর বড় কারণ। যেসব ব্যবসা তার পণ্য ই-কমার্স -এর মাধ্যমে বিক্রি করে, লাভবান হয়েছে তারা।
২) মানুষ যখন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ কমাতে বাধ্য হচ্ছেন, দেশের অর্থনীতির গতি রাখতে উন্নত হতে বাধ্য হচ্ছে সাপ্লাই চেন ব্যবস্থা। উৎপাদন ও ব্যবহারকারীর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা এঁদের কাজ।
এবার আসা যাক উল্টো দিকে। যেসব শিল্পক্ষেত্রকে করোনা ক্ষতির প্রবল ধাক্কা দিয়েছে, তাদের এখানে আমরা নাম দিলাম ‘কোভিড নেগেটিভ’।
অ্যাভিয়েশন :
১) ব্যাপক ক্ষতির মুখে বাণিজ্যিক বিমান পরিবহন সংস্থা, কারণ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্বাভাবিক বিমান চলাচল ব্যাহত।
২) কোভিড মানুষকে দীর্ঘমেয়াদে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে যাতায়াত কমাতে শিখিয়েছে। কারণ ভিডিও কনফারেন্স পদ্ধতিতে বহুক্ষেত্রে নিখরচে একই কাজ হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং বাণিজ্যিক পরিবহন কোভিড পূর্ববর্তী স্তরে খুব সহজে ফিরবে না।
৩) সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে কম সংখ্যায় বিমান ও কম সংখ্যায় যাত্রী নিয়ে উড়তে হচ্ছে।
ট্রাভেল ও ট্যুরিজম :
১) পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে বিশ্বব্যাপী মানুষ দেশভ্রমণের কথা ভাবছেন না। ট্যুরিজম পরিষেবা দেন এমন সংস্থার ব্যবসা প্রায় শূন্যে ঠেকেছে। অনেকে ‘ভারচুয়াল ট্যুরিজম’ এর মাধ্যমে ব্যবসা চালু রাখার চেষ্টা করছেন।
২) আপৎকালীন প্রয়োজন ছাড়া হোটেল -এর ব্যবহার নেই। অনেকে কোয়ারেন্টাইন পরিষেবা দিয়ে কাজ চালু রাখার চেষ্টা করছেন।
অটোমোবাইল – চার চাকা ও লাক্সারি গাড়ি :
১) নতুন করে বিলাসবহুল গাড়ি কিনছেন না প্রায় কেউ। সামাজিক মেলামেশা বন্ধ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য, এটাই মুখ্য কারণ।
২) কম দামি চার চাকার বিক্রি গ্রামাঞ্চলে শহরাঞ্চলের চেয়ে বেশি। শহরে যেটুকু বিক্রি হচ্ছে, তার অধিকাংশ অনলাইনে।
সিনেমা, রেস্তোরাঁ ও শপিং মল :
১) হলে গিয়ে সিনেমা দেখা বন্ধ। মার খেয়েছে মাল্টিপ্লেক্স।
২) সিনেমা তৈরির প্রক্রিয়া প্রায় স্তব্ধ, সামাজিক দূরত্বের কারণে। রিলিজ শুধুমাত্র অনলাইনে। প্রযোজক সংস্থাসহ সিনেমা ব্যবসা সংক্রান্ত সংস্থা ব্যাপক ক্ষতির মুখে।
৩) রেস্তোরাঁ খুললেও ক্রেতারা উৎসাহী নন। বড় থেকে ছোট – রেস্তোরাঁ বাণিজ্য ঝুঁকেছে অনলাইন ডেলিভারির দিকে।
৪) অতি প্রয়োজনীয় ছাড়া শপিং কমপ্লেক্স-এ ভিড় জমানো নিরাপদ নয়। মার খেয়েছে তাঁদের ব্যবসা।
ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল :
১) বিবাহ এদেশে একটি বড় মাপের চাহিদার কারণ। সামাজিক দূরত্বের বিধিবদ্ধতা বিবাহসংক্রান্ত বাজারকে প্রয়োজনের গণ্ডিতে বেঁধে দিয়েছে।
২) বিলাসবহুল সামাজিক আদানপ্রদান, এবং ভ্রমণ বন্ধ, সেজন্য কমেছে ফ্যাশন -এ খরচ করার প্রবণতা।
৩) প্রসাধন সামগ্রীর বিক্রি কমেছে।
8) বিউটি পার্লার, স্পা ইত্যাদি করোনার জন্য ব্যবসা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে।
রপ্তানি নির্ভর ব্যবসা :
১) যে সব সংস্থার ব্যবসা সম্পূর্ণ বা প্রধানত রপ্তানিনির্ভর, তারা মার্কিন দেশে ও ইউরোপে করোনার আগ্রাসনের জন্য বাণিজ্যিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
২) বিপিও সংস্থারা দেশের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হচ্ছেন।
৩) এইচওয়ানবি ভিসার নিয়ম বদলে যাওয়ায় বহু সংস্থা তাঁদের ব্যবসায়িক মডেল বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন।
তবে মনে রাখতে হবে, করোনা যত ক্ষতিই করুক, চিরকাল থাকবে না। একদিন তাকে বিদায় নিতেই হবে। বা মানুষ তাকে নিয়েই বাঁচার পন্থা শিখে নেবে। তাই এমন কিছু শিল্পক্ষেত্রের খোঁজ রাখা যাক, যা করোনার ওপর বেশি নির্ভরশীল নয়, বা যার সাময়িক ক্ষতি এড়িয়ে লাভে ফিরতে দেরি হবে না। এদের ক্ষেত্রে ‘আলফা’ ফ্যাক্টর উপেক্ষা করা যায়। তবে ফান্ডামেন্টাল-এর অন্যসব অঙ্ক মিলিয়ে নেওয়া জরুরি। এদের আমরা বলতেই পারি ‘কোভিড নিউট্রাল’।
ভারী পরিকাঠামো :
১) বিদ্যুৎ, বিদ্যুৎ পরিকাঠামো, বিদ্যুতে আর্থিক বিনিয়োগ – এই ধরনের কাজ যাদের, এবং কাজের এলাকা করোনার প্রকোপ থেকে দূরে, লকডাউন ও পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা প্রাথমিক ভাবে মেটার পর তাদের কাজ আগের জায়গায় আসতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
২) ইঞ্জিনিয়ারিং ও পরিকাঠামো প্রস্তুতকারী সংস্থারা অনেকে চীন থেকে ফিরে আসা ব্যবসা ঘরে তোলার সুযোগ পেয়েছে।
৩) ভারী শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহকারী – সিমেন্ট, ইস্পাত, লোহা ইত্যাদি। পরিকাঠামো তৈরি চালু থাকলে কাঁচামাল লাগবেই। এদের ওপর করোনার প্রভাব সীমিত।
ব্যাঙ্কিং ও ফাইনান্স :
১) করোনা আবহ এই ধরনের সংস্থার কাজে স্মার্টনেস বাড়িয়েছে। ঘরে ঘরে পরিষেবা দেওয়ার কাজে এরা অনেকদূর এগিয়ে গেছে।
২) ব্যাঙ্ক-এর ক্ষেত্রে এনপিএ-র ব্যাপারটা অন্য সব ফান্ডামেন্টাল-এর সঙ্গে সঙ্গে বিচার করা দরকার। এঁরা এনপিএ কমাতে মূলধনী পুনর্গঠন করছেন। তাও নজরে রাখতে হবে।
শেয়ারবাজার নিয়ে কথাপ্রসঙ্গে এখন যা না বললেই নয়, তা হল – বিকল্প বিনিয়োগের সুযোগ।
করোনা প্রায় সব শিল্পক্ষেত্রকে খরচ কমানোর পথে হাঁটতে বাধ্য করেছে। এজন্য বড়-মাঝারি-ছোট সব সংস্থা ঋণের পরিবর্তে বেশি করে ইক্যুইটির দিকে ঝুঁকছেন। এর ফলে কমবে তাঁদের সুদের খরচ। পরিবর্তে বিনিয়োগকারীরা পাবেন নতুন করে এই সব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করার পথ। এখন বাজারের দিকে লক্ষ্য রাখলেই খোঁজ পাওয়া যাবে বিভিন্ন ‘ইনিশিয়াল পাবলিক অফার’ বা আইপিও, ‘ফলোঅন পাবলিক অফার’ বা এফপিও এবং রাইটস ইস্যু। শেষেরটির সুযোগ সংশ্লিষ্ট সংস্থার বর্তমান বিনিয়োগকারীরাই পাবেন। যেকোনো পাবলিক অফারে অংশ নেওয়ার আগে পুরোপুরি বুঝে নিতে হবে সংস্থাটি লাভজনক কিনা।সেজন্য তার লাভ-ক্ষতির খতিয়ানেই নজর রাখতে হবে।
বিনিয়োগের জন্য নিয়মিত বাজারে আসে সরকারি ঋণপত্র। এগুলি সীমিত লাভ দেয়, কিন্তু নিরাপদ। সোনাতে বিনিয়োগের জন্য আছে সভারেন গোল্ড বন্ড এবং গোল্ড ইটিএফ। রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ করার জন্য আছে রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট বা আরইআইটি। লক্ষ্য রাখলে এগুলিতেও লাভজনক বিনিয়োগের সুযোগ পাওয়া যায়। এগুলি বিক্রি করা সম্ভব শেয়ারবাজারেই। লক ইন আছে কি না সেটুকুই জেনে নেওয়া প্রয়োজন। আর অবশ্যই জানতে হবে রিটার্ন-এর হার।
সুতরাং, শেয়ারবাজারে ঢোকার বা বেরনোর জন্য সঠিক সময়ের ব্যবহার করুন। সঠিক শেয়ার সঠিক পদ্ধতিতে বেছে নিন। প্রয়োজনে ইক্যুইটি ছাড়াও অন্যান্য বিনিয়োগে নজর রাখুন। লাভ হওয়া করোনাও রুখতে পারবে না।
আরও জানতে ফোন করুন এই নম্বরে +91 9051052222 বা ইমেল করুন [email protected]
–অদিতি নন্দী